চোখ ওঠা রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
চোখ ওঠা বা ডাক্তরি মতে Conjunctivitis, কন্জাঙ্কটিভাইটিস বলে। প্রচলিত ভাষায় চোখ ওঠা বলতে আমরা বুঝি, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে জল ঝরা, চোখের গেড়ানি কাটা ইত্যাদি। তবে মনে রাখবেন এগুলো এই চোখ ওঠা রোগের উপসর্গ মাত্র। চোখ লাল হওয়া, বা জল আসা এগুলো অনেক কারণে ও হতে পারে।
তবে আজকের আলোচনা করবো কেবলমাত্র চোখ ওঠা নিয়ে (এই সংক্রমণ ভাইরাস জনিত রোগটি অনেকে জয়বাংলা হিসেবে পরিচিত ) এই রোগটি আমাদের চোখের উপরের স্তরে একপ্রকার কন্জাঙ্কটিভাই প্রদাহের সৃস্টি হয়।
চোখ ওঠা রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
কেন চোখ ওঠে? এর উপসর্গ বা লক্ষণ কি? কি করবেন আর কি করবেন না? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন। সব কিছুর উত্তর জানতে হলে এই আর্টিকেল টি শেষ পর্যন্ত থাকলে অনেক কিছু জানতে পারবেন।
আবার অনেক পাঠক বন্ধু জানতে চায় চোখ ওঠার লক্ষণ ও প্রতিকার, চোখ উঠার ঘরোয়া চিকিৎসা, চোখ উঠলে করণীয় কি,চোখ ওঠার উপকারিতা, চোখ উঠলে কি কি খাওয়া যাবে না,চোখ ওঠা রোগের ঔষধ, চোখ ওঠা কি ছোঁয়াচে রোগ,চোখ ওঠা রোগের নাম, এই সব কিছুর বিস্তারিত আলোচনা হবে।
চোখ ওঠার কারণ
চোখ ওঠা অনেকটা ছোঁয়াচে রোগ, চোখ ওঠা ব্যাক্তির ব্যাবহৃত রুমাল,তোয়ালে,চশমা, বা কোন প্রসাধনী অন্যরা ব্যবহার করলে তারা ও কন্জাঙ্কটিভাইটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
এই রোগটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই আক্রান্ত ব্যাক্তির আসে পাশে না থাকার চেষ্টা করবেন।
এছাড়া ও অপরিছন্ন জীবন যাপন করলে, বিশেষ করে বর্ষা ঋতু শুরুতে এই ভাইরাস বায়ুর মাধম্যে সাচ্ছন্দে বেঁচে থাকতে পারে। এই সময়টা সতর্কতা থাকবেন।
ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সেবা মতানুসারে তিনটি কারণে চোখ ওঠা রোগটি হতে পারে, সেগুলি হলো -
১. ব্যাকটেরিয়া -
ব্যাকটেরিয়া যদি চোখে আক্রান্ত করে চোখ লাল হয়ে যাবে। হলুদ বা লালচে রঙের শ্লেষ্মা জাতীয় পদার্থ বা পুঁজ এর মত পদার্থ নির্গত হয়।
২. ভাইরাস -
ভাইরাস সংক্রমণ হলে চোখে অতিরিক্ত জল ঝরে এবং চোখ ফুলে যায়।
৩. এলাৰ্জি -
পশু পাখির পালক, ধুলাবালি ,ফুলের রেনু থেকে এলাৰ্জি থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় চোখ উঠতে পারে। এই ধরনের চোখ ওঠাকে এলাৰ্জি কন্জাঙ্কটিভাইটিস বলে।
চোখে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রমণ এ আক্রান্ত হলে কন্জাঙ্কটিভাইটিস রোগ বলা হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন সেনসিটিভ পদার্থের সংস্পর্শে ও চোখ জ্বালা পোড়া লাল হয়ে যাওয়া হতে পারে যেমন - শ্যাম্পু, সাবান, এবং সুইমিং পোলের ক্লোরিন যুক্ত পানি, চোখের আলগা পাপড়ি বা লেশ এক্সটেনশন এমনকি দূষণ যুক্ত ধোঁয়া ।
চশমা, রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া বা আই ড্রপের মাধ্যমে চোখ উঠতে পারে।
আবার বিভিন্ন যৌনবাহিত সংক্রমণের প্রভাবে যেমন -গনোরিয়া ও ক্লামাডিয়ার প্রভাবে ও চোখ ওঠার আশংকা থাকে।
ভাইরাস জনিত সংক্রমণ মূলত প্রথমে একটি চোখে আক্রান্ত হয়। এবং পরবর্তীকালে দুটি চোখে ঘটতে পারে।
চোখ ওঠার লক্ষণ বা উপসর্গ
Conjunctivitis, কন্জাঙ্কটিভাইটিস এর লক্ষণ হলো চোখ জ্বালা পোড়া, চোখের ভিতর অসস্থিভাব এবং সামান্য ব্যাথা থাকতে পারে। চোখের উপরের সাদা অংশে শিরা গুলোতে রক্ত জমবে, লাল বা টকটকে লাল দেখাবে।
রোদে বের হলে বা বেশি আলোর সংস্পর্শে কষ্ট হয়, মাত্রায় পানি ঝরে।
ঘুম থেকে ওঠার পর দুটি চোখ একত্রে লেগে থেকে জুড়ে যায়।
চোখ থেকে একপ্রকার শ্লেষ্মা জাতীয় পদার্থ হলুদ কিংবা সাদা পুঁজের মতো নির্গত হয়।
খালি চোখে ঝাপসা দেখা, চোখে কম দেখা ইত্যাদি এতগুলো উপসর্গ সবগুলি একসাথে একটি রুগীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে।
এটি সাধারনত প্রথমে একটি চোখে এবং পরবর্তী সময়ে দুটি চোখে হতে পারে।
চোখ উঠলে কি করবেন না/সতর্কতা!
চোখ উঠলে যেসব সাবধানতা অবলম্বন করা যায় তা হলো -
১. এই সময় চোখে বেশি চাপ দেয়া যাবে না। যেমন-বেশিক্ষন মোবাইল দেখা, টেলিভিশন দেখা, কম্পিউটার ল্যাপটপ ব্যবহার করা, ছোট ছোট লেখা রিডিং পড়া এই সমস্ত থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. ধুলোবালি, আলো, আগুন জ্বলা জায়গায় ধোঁয়া যেখানে থাকবে এমন জায়গায় যাবেন না।
৩. ময়লা আবর্জনা স্যাতস্যাতে জায়গায় যাবেন না এমনকি পুকুর নদীনালায় জলে স্নান/গোসল করবেন না।
৪. চোখ চুলকালে বা মিসমিস করলে কোনোভাবে রগড়ানো বা ঘষাঘষি করা যাবে না।
৫. চোখ মোছার রুমাল, বালিশের কভার, চশমা এবং রুগীর প্রসাধনী জিনিস নিয়মিত ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
---সর্দি কাশি কেন হয় এবং দূর করার ঘরোয়া উপায়
৬. এই সময় নিজের কোনো ব্যাবহৃত জিনিস কারোর সাথে শেয়ার করবেন না।
৭. চোখ সম্পূর্ণ না সেরে যাওয়া পর্যন্ত কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যাবে না। এবং আক্রান্ত হওয়ার পর কোনো লেন্স থাকলে সেটা আর ব্যবহার করা যাবে না।
৮. এমনকি চোখে অন্য কোনো প্রসাধনী যেমন- কাজল কিংবা অন্য কিছু ব্যাবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
চোখ উঠলে কি করবেন/ঘরোয়া চিকিৎসা বা প্রতিকার
এই সময় ঘরোয়া পদ্ধতিতে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
১. পরিষ্কার তুলোর সাদা কাপড়ের হলে ভালো গরম পানিতে ভিজিয়ে , ওই কাপড়টি একটু চেপে নিয়ে আলতো হাতে চোখের উপর প্রলেপ দেবেন, চোখ থেকে নির্গত পদার্থ গুলি এইভাবে পরিষ্কার রাখবেন দিনে কয়েকবার এর বেশি।
২. আপনার যদি দুটি চোখ সংক্রমিত হয় দুটি চোখের জন্য আলাদা আলাদা কাপড় এবং পানির পাত্র ব্যবহার করবেন।
৩. গরম কাপড়ের শেক দেয়ার পর ঠান্ডা পানিতে নরম কাপড় ভিজিয়ে শেক দিতে পারেন।
৪. কলের জলে গোসল করবেন।
৫. আপনার যদি দুটি চোখ সংক্রমিত হয় ১০- ১৫ দিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেবেন এবং কালো চশমা ব্যবহার করবেন।
৬. সংক্রমিত রুগীর থেকে দূরত্ত বজায় রাখবেন।
চোখ উঠলে কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন ?
চোখ উঠলে সাধারণত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। তবে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের সরনাপন্ন হবেন।
১.আপনার চোখ যদি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত যদি না স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।
২. বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই ডাক্তার দেখবেন যদি চোখ লাল হয়ে যায়। আর শিশুর বয়স যদি ২৮ দিনের কম হয় তাহলে জরুরি চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে হবে।
৩. চোখ খচখচ করার সাথে সাথে যদি ভীষণ ব্যাথা হয়, এবং মাথা ব্যাথা শরীর অসুস্থ হলে ডক্টরের কাছে যাবেন।
৪. দৃষ্টিশক্তিতে বেশি কিছু পরিবর্তন হলে , যেমন ঝাপসা দেখা, চোখে না দেখা, এবং চোখ থেকে রক্ত ঝরলে। তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরার্মশ নেয়া জরুরি।
৫. আর যারা নিয়মিত চোখে লেন্স ব্যাবহার করেন কিংবা চোখের পলক ব্যাবহার করেন তাদের এই রোগের উপসর্গ দেখা মেলে তাহলে চিকিৎসকের সহায়তা নেবেন। কারণ ওই সমস্ত বাহ্যিক লেন্স কিংবা বস্তুর জন্য চোখে এলাৰ্জি বা প্রদাহ হতে পারে।
চোখ ওঠা রোগের ঔষধ/চিকিৎসা
১. বিশেষ সতর্কবার্তা কোনো চোখের ড্রপের মেয়াদ যদি ১ থেকে ২ পর্যন্ত ও যদি থাকে। ড্রপ টি ওপেন করার পর ২৮ দিনের বেশি ব্যাবহার করা যাবে না।
২. ব্যাকটেরিয়ার কারণে চোখ উঠলে চিকিৎসক এন্ট্রিবায়োটিক চোখের ড্রপ বা মলম দিতে পারেন।
৩. ভাইরাস বা এলাৰ্জি কারণে চোখ উঠলে আন্টি হিস্টামিন বা এন্টি এলাৰ্জির ওষুধ, আই ড্রপ বা মলম দিতে পারেন।
তবে একজনের ঔষধ অন্যজন ব্যবহার করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ করবেন। আর চিকিৎসা সব সময় একই রকম হয় না চোখের অবস্থা বুঝে চিকিৎসক ওষুধ দিয়ে থাকেন। কোনো জরুরি অবস্থা হলে অতি অবসসই কাছাকাছি কোনো ভালো চিকিৎসকের কাছে যাবেন।
চোখ ওঠার পর কি কি খেলে উপকার
১.কিশমিশ
কিশমিশে প্রচুর পরিমানে পলিফেনলস উপস্থিত থাকায় আমাদের শরীর থেকে ফ্রি রাডিকেলস দূর করে। তার সাথে এটি চোখের মাসলের শক্তি উন্নতিতেও সহায়তা করে। আপনার চোখ ভালো রাখতে হলে প্রতিদিন কিশমিশ খেতে হবে। রাতে কিশমিশ ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি জল পান করলে উপকৃত হবেন।
২. পিংক সল্ট
পিংক সল্ট খেলে চোখের জন্য খুবই ভালো। চিকিৎসকরা বলেন, চোখ ভালো রাখতে বিশেষভাবে কাজ করে পিংক সল্ট। এই লবণে আছে ৮০টির অধিক
মাইক্রোমিনারেলস, যা কিনা চোখের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। তাই চোখ ওঠা বা কন্জাঙ্কটিভাইটিস সমস্যা দেখা দিলে খাবারে সাথে পিংক সল্ট যোগ করতে পারেন, তবে তা মাত্রাতিরিক্ত খাবেন না। কারণ, অতিরিক্ত লবণ মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৩.সবুজ শাক
গাঢ় সবুজ রঙের শাক যেমন - পালং , পুঁই , লেটুস ইত্যাদি খেলেও উপকার মিলবে। এই সমস্ত সবুজ শাকে অনেক পরিমানে ফলিক অ্যাসিড থাকে, যা চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সহায়তা করে।
৪. হলুদ এবং কমলা রঙের ফল
বেশিরভাগ ফল উপকারী তবে চোখের জন্য এই সমস্ত ফল ভালো। এই সমস্ত ফলে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন থাকায় চোখ ওঠা রোগ দূর করে। এমুনিটি পাওয়ার বর্ধিত করে। ..
চোখ উঠলে কি কি খাওয়া যাবে না
চোখ ওঠার সমস্যায় বা Conjunctivitis, কন্জাঙ্কটিভাইটিস ভুগলে ওই সময়ের জন্য বেশ কিছু খাবার এড়িয়ে চলাই খুব ভালো। তার মধ্যে আছে যেমন —
রিফাইন্ড খাবার, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার,ডুবোতেলে ভাজা,প্রসেসড মিট, মার্জারিন, ক্যান ফুড
আমাদের গুগল নিউজ পোস্ট গুলি ফলো করুন ☛ Google News